ভারতীয় দর্শনে কর্মের ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু একটি দার্শনিক তত্ত্বই নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে। কর্ম শব্দটি সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো কাজ করা। শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের কাজই কর্মের অন্তর্ভুক্ত। কর্মের সাথে কর্মফলের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করে। সৎ কর্মের ফল পুণ্য এবং অসৎ কর্মের ফল পাপ হিসেবে দেখা দেয়।
এই কর্মকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়: সকাম কর্ম এবং নিষ্কাম কর্ম। এই দুটি ধারণা ভারতীয় দর্শনে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। এদের মধ্যে পার্থক্য বোঝা গেলে জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
সকাম কর্ম কাকে বলে
সকাম কর্ম হল এমন কর্ম যেখানে ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা থাকে। এই ধরনের কর্মে রাগ, লোভ, মোহ ইত্যাদি মানবিক আবেগ জড়িত থাকে। মানুষ যখন কোনো কাজ করে এবং সেই কাজ থেকে কোনো ফলাফল পেতে চায়, তখন তাকে সকাম কর্ম বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যবসায়ী যদি শুধু লাভের আশায় ব্যবসা করে, তাহলে তা সকাম কর্ম। এখানে তার মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থ বা সম্পদ অর্জন। সকাম কর্মের বৈশিষ্ট্য হলো এটি কর্মফলের সাথে জড়িত। কর্মবাদের নীতি অনুসারে, সকাম কর্মের ফল সুখ বা দুঃখের রূপ নিতে পারে।
সকাম কর্মের ফলে জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। কারণ, কর্মফল ভোগের জন্য জীবকে সংসারে ফিরে আসতে হয়। এই চক্র থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। সকাম কর্মের জন্যই আত্মার দেহ ধারণ করতে হয় এবং সংসারের দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়।
নিষ্কাম কর্ম কী
নিষ্কাম কর্ম হল এমন কর্ম যেখানে ফলাফলের কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না। এই ধরনের কর্মে লোভ, লালসা বা কোনো প্রকার কামনা-বাসনা থাকে না। নিষ্কাম কর্মী শুধু কর্তব্যবোধ থেকে কাজ করে। তার মনে কোনো আসক্তি বা ফলাফলের প্রত্যাশা থাকে না।
উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক যদি শুধু জ্ঞান বিতরণের উদ্দেশ্যে ছাত্রদের পড়ান, তাহলে তা নিষ্কাম কর্ম। এখানে তার মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজের কল্যাণ করা, কোনো ব্যক্তিগত লাভ নয়। নিষ্কাম কর্মের বৈশিষ্ট্য হলো এটি বন্ধনমুক্ত। এই কর্মের ফলে জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয় না। কারণ, এখানে কোনো কর্মফল ভোগের প্রয়োজন পড়ে না।
স্বামী বিবেকানন্দ নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “কর্মফলের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করাই হলো নিষ্কাম কর্ম।” অর্থাৎ, কাজ করতে হবে কিন্তু ফলাফলের প্রতি মোহ থাকবে না। এই ধারণা গীতা থেকেও এসেছে। গীতায় বলা হয়েছে, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।” অর্থাৎ, কর্ম করাই তোমার অধিকার, ফলাফলের উপর তোমার কোনো অধিকার নেই।
সকাম ও নিষ্কাম কর্মের পার্থক্য
বৈশিষ্ট্য | সকাম কর্ম | নিষ্কাম কর্ম |
---|---|---|
ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা | থাকে | থাকে না |
কর্মের উদ্দেশ্য | ব্যক্তিগত লাভ বা সুখ | কর্তব্যবোধ বা সমাজের কল্যাণ |
আসক্তি | থাকে | থাকে না |
কর্মফল | সুখ বা দুঃখের রূপ নেয় | বন্ধনমুক্ত |
জন্ম-মৃত্যু চক্র | বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয় | জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি |
সকাম ও নিষ্কাম কর্মের প্রভাব
সকাম কর্ম মানুষের জীবনে অস্থিরতা আনে। কারণ, ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা মানুষকে চাপে রাখে। এই চাপ থেকে মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, নিষ্কাম কর্ম মানুষের মনে শান্তি আনে। কারণ, এখানে কোনো চাপ বা প্রত্যাশা থাকে না। নিষ্কাম কর্মী শুধু কাজ করে যায়, ফলাফলের দিকে তাকায় না।
নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে মানুষ আত্মিক উন্নতি লাভ করে। এটি মানুষকে সংসারের বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়। গীতায় বলা হয়েছে, “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।” অর্থাৎ, যোগের মাধ্যমে কাজ করো, আসক্তি ত্যাগ করো। এই বাণী নিষ্কাম কর্মের মূল কথা বলে।
মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের মনের দ্বন্দ্ব ও বিষন্নতা দূর করতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার মাধ্যমে কর্মের প্রকৃতি ও তার ফলাফল সম্পর্কে গভীর দর্শন উপস্থাপন করেছেন। তিনি সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম এই দুই প্রকার কর্মের কথা বলেছেন। এই দুই ধরনের কর্মের মধ্যে পার্থক্য বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও প্রযোজ্য। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা সকাম ও নিষ্কাম কর্মের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করব।
সকাম ও নিষ্কাম কর্মের মধ্যে পার্থক্য করো
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় সকাম ও নিষ্কাম কর্মের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য উল্লেখ করেছেন।
বিষয় | সকাম কর্ম | নিষ্কাম কর্ম |
---|---|---|
ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা | ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা থাকে। | ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা নেই। |
কর্মের উদ্দেশ্য | ব্যক্তিগত স্বার্থ বা লাভের জন্য। | কর্তব্যবোধ বা ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য। |
কর্মফলের প্রভাব | কর্মফল জমা হয় এবং ভোগ করতে হয়। | কর্মফল জমা হয় না। |
মানসিক অবস্থা | ভয়, উদ্বেগ ও চিন্তায় পূর্ণ। | শান্তি ও মুক্তির অনুভূতি। |
কর্মের জটিলতা | জটিল ও অসম্পূর্ণ হতে পারে। | সরল ও পূর্ণাঙ্গ। |
পাপের সম্ভাবনা | পাপের কারণ হতে পারে। | পাপের সম্ভাবনা নেই। |
সকাম কর্মের সমস্যা
১. ফলাফলের ভয়: সকাম কর্মে ব্যক্তি সবসময় ফলাফল নিয়ে চিন্তিত থাকে। এই চিন্তা তাকে ভীত ও উদ্বিগ্ন করে তোলে।
২. অসম্পূর্ণতা: সকাম কর্ম অনেক সময় জটিল হয়ে পড়ে এবং অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
৩. পাপের সম্ভাবনা: সকাম কর্মে ব্যক্তি অনেক সময় অন্যায় বা প্রতারণার পথ বেছে নেয়, যা পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
৪. বুদ্ধির বিভ্রান্তি: সকাম কর্মে ব্যক্তির বুদ্ধি বহির্মুখী হয়, অর্থাৎ তা নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং একাগ্রতা হারায়।
নিষ্কাম কর্মের সুবিধা
১. মুক্তি: নিষ্কাম কর্মে ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা না থাকায় ব্যক্তি কর্মফলের বন্ধন থেকে মুক্ত থাকে।
২. শান্তি: এই কর্মে ব্যক্তির মন শান্ত ও স্থির থাকে, কারণ কোনো চিন্তা বা ভয় নেই।
৩. পূর্ণাঙ্গতা: নিষ্কাম কর্ম সরল ও পূর্ণাঙ্গ হয়, কারণ এতে কোনো জটিলতা থাকে না।
৪. ঈশ্বরের সান্নিধ্য: নিষ্কাম কর্মে ব্যক্তির বুদ্ধি ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়, ফলে তার মধ্যে একাগ্রতা ও নিষ্ঠা বাড়ে।
গীতার শিক্ষা নিষ্কাম কর্মই মুক্তির পথ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন, “কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন” অর্থাৎ, কর্ম করাই তোমার অধিকার, কিন্তু ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা করো না। এই বাণী আমাদের শেখায় যে, আমরা শুধু আমাদের কর্তব্য সম্পাদন করব, কিন্তু ফলাফল নিয়ে চিন্তা করব না। এই নিষ্কাম ভাবনাই আমাদের সংসার থেকে মুক্তি দিতে পারে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সকাম ও নিষ্কাম কর্মের পার্থক্য বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, একজন ছাত্র যদি শুধু নম্বর পাওয়ার জন্য পড়াশোনা করে, তাহলে তা সকাম কর্ম। কিন্তু যদি সে জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ে, তাহলে তা নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কাম কর্মে আমাদের মন শান্ত থাকে এবং আমরা আমাদের লক্ষ্যে সহজেই পৌঁছাতে পারি।
শেষ কথা
ভারতীয় দর্শনে সকাম ও নিষ্কাম কর্ম দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সকাম কর্ম মানুষকে সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ রাখে। অন্যদিকে, নিষ্কাম কর্ম মানুষকে মুক্তির পথ দেখায়। স্বামী বিবেকানন্দ ও গীতার বাণী অনুসারে, নিষ্কাম কর্মই হলো জীবনের সঠিক পথ। এটি মানুষকে আত্মিক শান্তি ও মুক্তি দেয়। আমাদের উচিত নিষ্কাম কর্মের পথ অনুসরণ করা। ফলাফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে শুধু কাজ করা। এই পথেই জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আজকাল বাংলায় সাধারণজ্ঞান সম্পর্কিত তথ্য পেতে মূলপাতা ঘুরে দেখুন।